বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ট্রাম্প এবং করোনাভাইরাস প্রসঙ্গ

হুমকি আগেই দিয়েছিলেন। এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থ দেওয়া বন্ধ করে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেছেন, ‘আপাতত ওই সংস্থাকে অর্থ দেবে না অ্যামেরিকা।’ এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে।
এর আগে ট্রাম্প অভিযোগ করেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করেছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেন তিনি। ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাসচিব বলেন, ‘বিশ্বের এ পরিস্থিতিতে রাজনীতি বন্ধ করুন। নইলে আরও বেশি মৃতদেহ দেখতে হবে।’
ট্রাম্পের এমন অভিযোগের মূল কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করা যাক। গত বুধবার ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ‘চীন-কেন্দ্রিক’ বলে অভিযোগ করেন এবং সংস্থাটি মহামারি মোকাবিলায় ‘বিশৃঙ্খলা’ করেছে বলে সমালোচনা করেন। তার আগের দিন সংবাদ সম্মেলনেও একই ধরনের অভিযোগ করে সংস্থাটির সততা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সবচেয়ে বেশি অর্থ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তার প্রতিদান তারা দিতে পারেনি’। ট্রাম্পের অভিযোগ, ‘চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অনেক কম অর্থ সহায়তা দেয়, তা সত্ত্বেও তারা চীন নিয়ে মেতে আছে।’
মূলত, ট্রাম্প শুরুতে ঘোষণা করেছিলেন হু-এর ফান্ডিং বন্ধ করা হবে। অবশ্য পরে তিনি নিজের বক্তব্য থেকে সরে গিয়ে বলেন, তিনি এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করবেন। জবাবে হু’র প্রধান জানান, ‘যেহেতু চীনেই প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তাই ভাইরাসের উৎস খুঁজতে চীনে ধারাবাহিক কাজ চালাচ্ছে তাদের সংস্থা। এটাই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া।’
এপ্রিলের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে করোনার ভয়াবহতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সির পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কারণ, আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে হু মহাসচিব সুস্পষ্ট করে বলেছেন, নভেল করোনাভাইরাস নিয়ে রাজনীতি করা উচিত না। বরং দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঐক্য জোরদারের ভিত্তিতে মহামারি মোকাবিলা করা উচিত।
এদিকে, জাতিসংঘ মহাসচিব অন্তোনিও গুতেরহিস এক বিবৃতিতে কোভিড-১৯ রোগ প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশের প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-কে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মহাসচিব জোর দিয়ে বলেন, হু-কে সমর্থন দেওয়া সারা বিশ্বে ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য খুব জরুরি। বর্তমানে সব দেশের উচিত সুসংহত হয়ে ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য যৌথ ব্যবস্থা নেওয়া।
তিনি আরও বলেন, হু’র হাজার হাজার কর্মী এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাইরাস প্রতিরোধে নিজের অবদান রাখছে, বিশেষ করে চিকিৎসা ব্যবস্থায় দুর্বল দেশগুলোতে সহায়তা করছে। এছাড়া, ইবোলা ভাইরাস প্রতিরোধে হু’র অবদান উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে চীন মনে করছে, করোনাভাইরাসের উত্স অনুসন্ধান একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়। এজন্য গবেষণা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কোনও বৈষম্যমূলক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। চীনকে অপমান করলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আসলে, চলমান বিশ্বে মহামারি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে মার্কিন পক্ষের এ সিদ্ধান্ত হু’র স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা দেবে এবং মহামারি রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
উল্লেখ্য, চীন সরকার বর্তমানে বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশ ও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এন ৯৫ মাস্ক, ভেন্টিলেটরসহ নানা চিকিত্সাসামগ্রী অনুদান দিচ্ছে। সম্প্রতি হু-তে ২ কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তাও দিয়েছে চীন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তিশালী দেশটি এত বড় দুর্যোগে কার পাশে দাঁড়িয়েছে? করোনাভাইরাসের হটস্পট এখন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। করোনার কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। সব মিলিয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা ট্রাম্প সরকারের। এমন সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট তার ক্ষোভ ঝারছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওপর। এমনকি মার্কিন-বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে ভাইরাস মোকাবিলাসংক্রান্ত পণ্য রফতানি নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত দিয়েছে! ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা সম্প্রতি এক খবরে বলে, ‘মহামারি ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে, মার্কিন সরকার তার ভুল ও দায় অস্বীকার করছে। ’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কী পরিমাণ অর্থ দেয় যুক্তরাষ্ট্র?
২০১৯ সালে মোট অনুদানের পরিমাণ ছিল ৫.৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে নির্ধারিত অনুদান ছিল ৯৫৬ মার্কিন ডলার। নির্দিষ্ট স্বেচ্ছানুদান ছিল ৪.৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মূল স্বেচ্ছানুদান ছিল ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পিআইপি অনুদান ছিল ১৭৮ মিলিনয় মার্কিন ডলার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল আর্থিক জোগানদাতা এখন আমেরিকা, মোট আয়ের ১৪.৬৭ শতাংশ অর্থাৎ ৫৫৩.১ মিলিয়ন ডলার দিয়ে থাকে তারা। এরপরই রয়েছে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন, যারা ৯.৭৬ শতাংশ অথবা ৩৬৭.৭ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়।
তৃতীয় বৃহত্তম অনুদানকারী সংস্থা হল গাবি ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স, তারা দিয়ে তাকে ৮.৩৯ শতাংশ। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান রয়েছে যথাক্রমে ব্রিটেন ৭.৭৯ শতাংশ, এবং জার্মানি ৫.৬৮ শতাংশ।
পরবর্তী চার বৃহত্তম অনুদানকারী হলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অফ হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স (৫.০৯ শতাংশ), বিশ্ব ব্যাঙ্ক (৩.৪২ শতাংশ), রোটারি ইন্টারন্যাশনাল (৩.৩ শতাংশ), এবং ইউরোপিয়ান কমিশন (৩.৩ শতাংশ)। ভারত মোট অনুদানের ০.৪৮ শতাংশ দিয়ে থাকে। চীন দেয় ০.২১ শতাংশ।
মোহাম্মদ তৌহিদ: বিদেশি বিশেষজ্ঞ, চীন আন্তর্জাতিক বেতার, বেইজিং।