কেউ তোমাকে পছন্দ করবে এই আশায় নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলো না...তুমি যেমন আছ তেমনই থাকার চেষ্টা কর... যে তোমাকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসবে সে সত্যিকারের তোমাকেই ভালোবাসবে...

Definition List

ইংরেজি ভাষায় বিসিএস কেন ? : শিশির ভট্টাচার্য

ইংরেজি ভাষায় বিসিএস
কেন?
শিশির ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে:
প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ১৯৮৭
সালের বাংলা প্রচলন আইনে বলা
হয়েছে, বিদেশের সঙ্গে
যোগাযোগ ব্যতীত সব সরকারি, আধা
সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের
কাজকর্ম বাংলায় হতে হবে। বাংলা ভাষা
ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায়
আবেদন বা আপিল করা হলে সেটা
বেআইনি ও অকার্যকর গণ্য হবে। যদি
কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এ
আইন অমান্য করেন, তবে তিনি অসদাচরণ
করেছেন বলে গণ্য হবে এবং সেই
কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সরকারি কর্মকমিশন ৩৮তম বিসিএস
পরীক্ষা ইংরেজিতেও নেওয়ার
সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের প্রশ্ন: এই
সিদ্ধান্ত কি প্রথমত সংবিধান এবং দ্বিতীয়ত
বাংলা প্রচলন আইনের পরিপন্থী নয়?
পৃথিবীর কোনো দেশে কি
রাষ্ট্রভাষা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায়
সরকারি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা
নেওয়ার উদাহরণ আছে? জাপান, জার্মানি,
রাশিয়া প্রভৃতি দেশে রাষ্ট্রভাষার জন্য
কোনো আন্দোলন হয়নি, কিন্তু
জাপানি, জার্মান বা রুশ ছাড়া অন্য কোনো
ভাষায় রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম চালানোর কথা
কি ভাবা যায় এসব দেশে?
সরকারি কর্মকমিশন স্বীকার করেছে
যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
গ্র্যাজুয়েটদের প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত
করার জন্যই দ্বৈত বিসিএসের সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়েছে। ‘বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যম কেন
ইংরেজিই হতে হবে?’ অথবা ‘ব্যবসায়,
বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয় কেন
ইংরেজিতেই পড়তে হবে?’ এসব সংগত
প্রশ্নে আমরা যাচ্ছি না। বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার ছাগল লেজে
কাটবে, নাকি মাথায় কাটবে, সেটা তার
ব্যাপার। কিন্তু আগামীকাল যদি
মাদ্রাসাগুলো দাবি করে যে বিসিএস
পরীক্ষা আরবি-উর্দু-ফারসিতেও নিতে
হবে, তখন কমিশন কী উত্তর দেবে?
ইংরেজি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা নয়।
ঔপনিবেশিক কারণে বাংলাদেশে
ইংরেজির যদি একটি বিশেষ স্থান সৃষ্টি
হয়ে থাকে, তবে ধর্মীয় শিক্ষাগত
কারণে আরবি-উর্দু-ফারসিরও একটি বিশেষ
স্থান সৃষ্টি হয়েছে। হাতে গোনা
কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, যেখানে আরবি
বহু হাজার মাদ্রাসার শিক্ষার মাধ্যম।
ভাষার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের
উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার
অবমূল্যায়নের সমান্তরালে বাংলাভাষী
মানুষেরও অবমূল্যায়ন হবে। ইংরেজি না
জানার কারণে নীতিনির্ধারণে বাংলাভাষী
জনগোষ্ঠীর ভূমিকা থাকবে না
বাংলাদেশ সরকারের চাকরি করতে চাইবে
বাংলাদেশের একজন নাগরিক অথচ সে
রাষ্ট্রভাষা বাংলা শুদ্ধভাবে লিখতে, পড়তে,
বলতে জানবে না—এমন সৃষ্টিছাড়া আবদার
শুধু শিবঠাকুরের আপন দেশেই সম্ভব।
বাংলা জানে না বলে যে ব্যক্তি
ইংরেজিতে বিসিএস পরীক্ষা দিতে বাধ্য
হচ্ছে, সে কীভাবে প্রশাসনে বাংলা
ব্যবহার করবে? প্রশাসন যেহেতু তার
বাংলা না জানা মেনে নিয়েই তাকে
নিয়োগ দিচ্ছে, সেহেতু বাংলা
ব্যবহারে তাকে বাধ্য করার নৈতিক অধিকার
প্রশাসনের থাকবে না। এর ফলে
প্রশাসনে বাংলা প্রচলনে ইতিমধ্যে
যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, সেটুকুও
অনতিবিলম্বে হারিয়ে যাবে।
ইংরেজি ভাষায় বিসিএস পরীক্ষাকে
যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে,
প্রশাসনে যথেষ্ট ইংরেজি জানা লোক
নেই। একসময় ইংরেজি কম জানার
অজুহাতে পররাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ
মন্ত্রণালয়গুলোতে এবং প্রশাসনের
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের আর
নেওয়াই হবে না। কালক্রমে
আমলাতন্ত্রে ‘ইংরেজি’ এবং ‘বাংলা’—এই দুটি
গোষ্ঠী সৃষ্টি হবে এবং দুই
গোষ্ঠীর মধ্যে সুযোগ-সুবিধার
ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে রেষারেষি শুরু
হবে। এই প্রতিযোগিতায় ‘বাংলা’ আমলারা
পরাজিত হবেন। কারণ বাংলা সাবান, বাংলা বাড়ি,
বাংলা মদ, বাংলা ভাই, বাংলা সন ইত্যাদি বাংলা
যেকোনো কিছুকে বাঙালিরা সাধারণত
কিছুটা অবজ্ঞার চোখেই দেখে
থাকে।
বিসিএস পরীক্ষায় ইংরেজি পেপারে যারা
বেশি নম্বর পাবে, তাদের নিয়োগ
দিয়ে ইংরেজি জানা লোকের ঘাটতি
মেটানো যেতে পারে। ইতিমধ্যে
নিয়োগপ্রাপ্ত আমলাদের জন্য কথ্য ও
লেখ্য ইংরেজি ভাষা কোর্সের
ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা
কোনো সমস্যার সহজ সমাধানে
আগ্রহী নন। পরবর্তী প্রজন্মকে
ইংরেজি শেখানোর জন্য ইংলিশ
মিডিয়ামের অনুমতি দিয়ে তাঁরা অতীতে
একটি ভুল করেছিলেন। এবার চোস্ত
ইংরেজি জানা আমলা সরবরাহ নিশ্চিত করতে
ইংরেজিতে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে তাঁরা
আরও একটি ভুল করতে চলেছেন।
নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে ইংরেজিতে
বিসিএস চালু হলে বাংলা মিডিয়াম এবং পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব ধাপে ধাপে
কমে আসবে। অভিভাবকেরা সামর্থ্য
থাকলে ছেলেমেয়েদের বাংলা
মিডিয়াম স্কুলে আর ভর্তি করতে
চাইবেন না। বাংলা না শিখে যদি চলে, তবে
সন্তানদের বাংলা শেখানোর ঝামেলায় বা
তারা কেন যেতে চাইবেন? একসময়
দেখা যাবে, পারতপক্ষে বাংলায় আর
কেউ বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছে না। সবাই
ইংরেজিতে পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি
নিচ্ছে।
প্রশাসনের চৌকস আমলারা নিজেদের
মধ্যে ইংরেজি এবং জনগণের সঙ্গে
বাংরেজি বলবেন। ইংরেজি শব্দবহুল এবং
ইংরেজি উচ্চারণে বলা বাংরেজি চেপে
বসবে সমাজের সর্বত্র, কারণ সেই
উপভাষাটিকে তখন বেশি ফ্যাশনেবল
মনে হবে। আদালতে এবং শিক্ষায় বাংলা
ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হয়নি।
ধীরে ধীরে প্রশাসন, ব্যবসায়
এমনকি সংস্কৃতিতেও বাংলার ব্যবহার হ্রাস
পাবে। বিচিত্র ব্যবহার না হওয়ার কারণে
বাংলার প্রকাশশক্তি এতটাই হ্রাস পাবে যে
একসময় বাঙালিরাই বিশ্বাস করবে না, বাংলা
সর্বস্তরে ব্যবহারের উপযুক্ত
কোনো ভাষা। আফ্রিকার অনেক
দেশে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
রুয়ান্ডার হুতু ও তুতসিরা ভাবতেও পারে না
যে ফরাসিকে বাদ দিয়ে তাদের
নিজেদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা কিংবা
আদালতে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব।
ভাষার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের
উন্নয়ন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাংলা ভাষার
অবমূল্যায়নের সমান্তরালে বাংলাভাষী
মানুষেরও অবমূল্যায়ন হবে। ইংরেজি না
জানার কারণে নীতিনির্ধারণে বাংলাভাষী
জনগোষ্ঠীর ভূমিকা থাকবে না।
ইংরেজি না-জানা বাঙালিদের উত্তরপুরুষেরা
একসময় ইংরেজি শিখে আবার
ক্ষমতাসীন হবে ঠিকই, কিন্তু তত দিনে
অনেকগুলো প্রজন্ম হারিয়ে যাবে,
নষ্ট হয়ে যাবে অনেকখানি সময়।
অন্যান্য জাতি ইত্যবসরে অর্থনৈতিকভাবে
এগিয়ে যাবে এবং বাঙালিরা তখনো ভিন
জাতির দেশে গিয়ে কামলা খেটে
খেটে শরীর ও মেধার অপচয়
করতে বাধ্য হবে।
উত্তরপুরুষদের অর্থনৈতিক সৌভাগ্যের
আশায় ’৪৮-৫২ সালে ভাষাশহীদেরা
নিজেদের জীবনের ঝুঁকি
নিয়েছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে
হচ্ছে, সালাম-রফিক-বরকতের যাবতীয়
অর্জন অচিরেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত
হয়ে একদিন স্মৃতির বিষয়ে পরিণত হবে।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদ্যু
একবার বলেছিলেন: ‘ফরাসি ভাষার
প্রশ্নে আমরা যদি ছাড় দিই তবে আমরা
একেবারে ভেসে যাব।’ রক্তের
দামে কেনা রাষ্ট্রভাষার অধিকারের
প্রশ্নে আমরা যদি সদা সতর্ক না থাকি,
তবে আমাদেরও পায়ের তলার মাটি
সরে যাবে—এতে কোনো
সন্দেহ নেই।
শিশির ভট্টাচার্য : অধ্যাপক, আধুনিক
ভাষাশিক্ষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Blogger দ্বারা পরিচালিত.