যিনি খাট থেকে উঠতে পারেন না, তিনিও স্বপ্ন দেখেন
অনেক স্টুডেন্ট আছে যারা ভাবে, ও তো অনেক বড়লোক, আমার জীবন তো অনেক কষ্টের। ও তো ভাল ইংরেজি জানে, আমি তো ইংরেজি জানিনা। ও তো অনেক স্মার্ট, আমি তো স্মার্ট না। ওকে দেখি অনেক ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়ে। কেউ প্রিন্সটনে পড়ে, কেউ সিমেন্সে পড়ে, কেউ নর্দার্ন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে,তাদের সঙ্গে তোমাদের কম্পিটিশন। সো, লাইফ ইজ নট ইজি, লাইফ ইজ এ প্লেস টু স্ট্রাগল। এই জীবনযুদ্ধে কি করে বাঁচবে?এই যুদ্ধে কি করে এগোবে?
আমি একটি কথাই বলছি। সবুর সাহেব বা এই টিচাররা যারা আছেন, তারা যদি আজ এখানে এতবড় স্বপ্নদ্রষ্টা হতে পারেন, আনিসুল হকের মতন একটি মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা ছেলে, যে একসময় মাইলের পর মেইল হেঁটে স্কুলে গেছে, মফস্বলের স্কুলে পড়াশোনা করেছে, মফস্বলের ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে, তোমাদের মতন ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ হয়নি, তোমাদের মতন এরকম ক্যাম্পাসে আসার সুযোগ হয়নি, সেই যদি ছোট্ট একজন মেয়র হতে পারে, তোমরা তাহলে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্টুডেন্ট আর সর্বশ্রেষ্ঠ নাগরিক হতে পার।
হ্যাভ দ্যাট কনফিডেন্স ইন ইউর মাইন্ড, প্লিজ। আমি কিন্তু মিথ্যে কথা বলছিনা। জীবনের পরতে পরতে অনেক সংগ্রাম করে এসেছি, জীবনকে আমরা তখন দেখতে পেতাম না। তখন ইন্টারনেট ছিলনা, আমাদের কাছে সারা পৃথিবী উন্মুক্ত ছিলনা। তোমরা কিন্তু এখন জীবনকে দেখতে পাও। বিশ্বাস রাখো যে ‘আমিই পারবো’।
মানুষ পারেনা, এমন কিছু নেই। মানুষের জন্যই বলা হয়, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, মানুষ কখনো কখনো স্বপ্নের চাইতেও বড়। সেই স্বপ্নকে যদি তোমাকে ধরতে হয়, সেই স্বপ্ন দেখতে হবে। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি কী ছিল? আমি জানিনা কে কী বলবে। আমি নিশ্চিতভাবে তোমাদের বলতে পারি, আমি যেকোনো জায়গায় বলব, যেকোনো পরিস্থিতিতে বলব, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল আমার মায়ের দোয়া। তোমাদের কাছে এটা ইমোশনাল কথা মনে হতে পারে, কিন্তু জীবনে যখন আমার জায়গায় আসবে বা আমাদের জায়গায় আসবে, তখন দেখবে, সেই দোয়ার কী শক্তি!

আমার মা আর দশজন মায়ের মতন শিক্ষিত নন। মা বললেন, ‘এটা হয় নাকি রে বাবা? তুমি যদি এবার পরীক্ষা না দাও, তুমি তো একবছর পিছিয়ে যাবে।’ আমি বললাম, ‘আমার তো উপায় নেই, আমি তো চোখেই কিছু দেখছিনা।’ উনি অনেক দোয়া টোয়া পড়ে আমাকে ফুঁ দিলেন, তারপর হাতটা ধরে বললেন, ‘চলো যাই।’ পরীক্ষার সময় ৩ ঘন্টা, ২ ঘন্টা পরীক্ষা দিয়েই বেরিয়ে গেলাম। বাইরে বিপর্যস্ত অবস্থায় মা বসে বসে ভাবছিলেন, ‘আমার ছেলে না জানি কি করছে ভেতরে!’ আমি বের হতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘পরীক্ষা শেষ হয়েছে? সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছ?’ আমি বললাম, ‘না মা,মাত্র ৩৪ নাম্বার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।’
মা বললেন, ‘পাস কততে?’ আমি বললাম, ‘পাস তো ৩৩ এ, তোমার ফুঁ-তে কাজ হলোনা।’ মা বললেন,-কাজ না হোক, আসো আরেকটা ফুঁ দিয়ে দিই।’ মা ওখানেই দু’রাকাত নামায পড়ে একটা ফুঁ দিলেন আমার সারা শরীরে। বিশ্বাস কর, হয়তো এটা কাকতালীয় ব্যাপার, কিন্তু আমি আজও বিশ্বাস করি। আমি সেই পরীক্ষায় ৩৪-এ ৩৪-ই পেয়েছিলাম! এই আনিসুল হকের জীবন সেই মায়ের দোয়াতেই আজ এ পর্যায়ে এসেছে, এমনকি এখনো কিছু হলেই মায়ের কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াই।
আরেকজন মায়ের গল্প বলি, এই মায়ের গল্প তোমরা পড়েছো। শুধু মায়েরাই পারেন এটা করতে। ১৯৭১ সাল, ১৫ আগস্ট। একটি ছেলে রমনা থানায় আটকে গেছে। মাকে খবর পাঠানো হলো যে, ছেলেকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, কারণ সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে চায়। সন্ধ্যার সময় মা ছুটে গেলেন। জড়িয়ে ধরতে পারেননা, কারণ মাঝখানে তো লোহার শিকের দেয়াল।
ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মা, তিনদিন ধরে এখানে আছি, ভাত খেতে দেয়না।’ মা আর কোনো কথা না বলে ছুটে গেলেন বাসায়, তিন ঘন্টা পর এলেন ভাত নিয়ে, কিন্তু এসে দেখেন ছেলে আর নেই, ছেলেকে আর পাওয়া যায়নি। মা মারা গেছেন ১৫ বছর পর, ১৯৮৫ সালে, সেই একই দিনে। কিন্তু এই ১৫ বছর তিনি একবারো ভাত মুখে দেননি, কারণ তিনি তার ছেলেকে ভাত খাওয়াতে পারেননি। এই হলেন মা।
সুতরাং এই বয়সে এসে আমি তোমাদের বলি, আমার বয়সে কিন্তু আমি বুঝতাম না, মা বাবার দোয়া আর পরিশ্রম কত মূল্যবান। তাদেরও একটা স্বপ্ন আছে তোমাকে নিয়ে, সেজন্যই এত কষ্ট করে তোমাকে পড়ান। ওদের একটা স্বপ্ন আছে, ছেলে এটা হবে, ওটা হবে। তোমার স্বপ্নের সাথে তা নাও মিলতে পারে। জীবনে স্বপ্ন নেই, এমন কোন মানুষ নেই, স্বপ্নই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আমার বাবা, যার বয়স ৯৫ বছর, যিনি খাট থেকে উঠতে পারেননা, তাকেও আমি স্বপ্ন দেখতে দেখি।
একবছর বা ৮ মাস আগে তার স্বপ্ন ছিল, ছেলে তো অনেক জায়গায় অনেক মাতবরি করেছে, ছেলেটা যদি মেয়র হয়! তার স্বপ্ন ছিল, তার একটা ছেলে আর্মিতে কাজ করুক। আমার ছোটভাইকে তিনি বললেন, ‘আমি চাই,আমার কোন এক ছেলে আর্মির মতন স্যালুট নিক।’
ছোটভাই খুব স্কলার ছেলে ছিল, সে তার স্বপ্নকে ছেড়ে দিয়ে বাবার স্বপ্নের সাথে নিজের স্বপ্নকে মিলিয়ে আর্মিতে গিয়েছিল। বাবা চেয়েছিলেন, তার ছেলে সেনাবাহিনীর প্রধান হবে। আল্লাহ আমার বাবা মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তোমাদেরও বলি, মা বাবার স্বপ্নের সাথে তোমার স্বপ্ন মিলবে, এমন কোন কথা নেই। আজকে সকালে আমার বাবা বলছিলেন, ‘একটু দেশের বাড়িতে যাওয়া যায়না?’ আমি বলি, আমার বাবাকে তো হেলিকপ্টারেও নেবার উপায় নেই। তার মানে কী? মানুষ মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও স্বপ্ন দেখে।
আর তোমরা কত ভাগ্যবান যে, তোমাদের স্বপ্নের সময় মাত্র শুরু হলো! আমার বাবা বলতেন, সব মুরব্বিরা বলেন, তোমাদের টিচাররা বলেন, জীবনে বড় স্বপ্ন দেখ। জীবনের ৪০ বছর বয়সে কী হতে চাও, ৪৫ বছর বয়সে কী হতে চাও, ৫০ বছর বয়সে কী হতে চাও, সেই স্বপ্ন দেখ। কথাগুলো এজন্যই বললাম যে, জীবনে অনেক বড় ধরনের ভাঙন আসবে, তোমরা যারা মধ্যবিত্ত, তারা দেখবে, একসময় বাবা আর পড়াতে পারছেনা।
দেখবে, তুমি একসময় কোনো কারণে নরমাল গতি থেকে হারিয়ে গেছো। ডোন্ট লুজ ইউর কারেজ! ১৫ বছর আগেও কিন্তু সবুর সাহেবের এই স্বপ্ন ছিলনা, ২০ বছর আগে তো ছিলই না। এতবড় একটি স্বপ্নের বাগান যদি সবুর সাহেব তৈরি করতে পারেন, একজন সামান্য মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা আনিসুল হক যদি ছোটখাটো মেয়র হতে পারে, তোমার তো তাহলে পৃথিবী জয় করতে পারো! ইউ ক্যান উইন দ্য ওয়ার্ল্ড, এন্ড প্লিজ হ্যাভ ইউর কনফিডেন্স। এই একটা জিনিসই মানুষকে বদলে দেয়। যদি হাওয়া খেতে হয়,তবে নদীর তীরে যেতে হয়।
যদি সুন্দর সাগর দেখতে হয়, কক্সবাজার যেতে হয়। যদি সুন্দর পর্বত দেখতে হয়, হিমালয় যেতে হয়। যদি ভাল মানুষ হতে হয়, ভাল মানুষের সাথে মিশতে হয়, ভাল মানুষের কথা পড়তে হয়। তোমরা ভাল মানুষের বই পড়ো, ভাল মানুষের জীবনী পড়ো।
__________
কথা গুলো ঢাকার শহরের সদ্যপ্রয়াত মেয়র ও অনুষ্ঠান উপস্থাপক আনিসুল হকের। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে এসে দেওয়া বক্তৃতায় কথাগুলো বলেছিলেন তিনি।