কেউ তোমাকে পছন্দ করবে এই আশায় নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলো না...তুমি যেমন আছ তেমনই থাকার চেষ্টা কর... যে তোমাকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসবে সে সত্যিকারের তোমাকেই ভালোবাসবে...

Definition List

মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই”

শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্য যাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল তিনি হলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষুরধার লেখনীকে তিনি রেখেছিলেন অব্যাহত। বাংলা কাব্য ও সংগীতে কাজী নজরুল ইসলাম এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন।
লেখক সুভাষ বসুর নজরুলকে নিয়ে বলা একটি উক্তি করছি, যে উক্তিতে তিনি বলেন, ‘‘আমরা যখন যুদ্ধে যাব- তখন নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব-তখনও নজরুলের গান গাইব।” আমরা তাই নজরুল কে শুধু কবি পুরোধা দিয়ে আবদ্ধ করতে চাই না। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক উচ্ছল যৌবনা নদীর ন্যায়। নদীর ঢেউ যেমন বয়ে চলে নিরবধি, ঠিক তেমনি নজরুলও তাঁর কলমকে চালিয়েছিলেন সাহিত্যের সকল শাখায়। তিনি যেমন কবি, তেমনি একজন ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। যেমনি একজন সম্পাদক তেমনি একজন নাট্যকার ও অনুবাদক। প্রাবন্ধিক বা চলচ্চিত্র পরিচালকও তিনি।
বৃটিশ-বেনিয়াদের বুকে ঝড়তোলা কবি নজরুল ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ই জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।
কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাণ, পত্রিকা সম্পাদনা সবক্ষেত্রেই আমরা তাঁর সফল পদচারণা দেখেছি এই সব্যসাচী কবির যা আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে বিরল। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের জীবনের মাত্র ৪২ বছর বয়সে সৃজনশীলতায় অনন্য এ কবি আক্রান্ত হন পিকস্ ডিজেজ এ। বন্ধ হয় তাঁর ক্ষুরধার লিখনি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিশেষ উদ্যোগে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। জাতীয় কবির জন্য ধানমন্ডিত বসবাসের জন্য বাসভবন বরাদ্দ করা হয় এবং তাঁর চিকিৎসা ও পরিচর্যার যাবতীয় ব্যবস্থাও করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
কলম যে বন্দুকের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে পারে তা তিনি প্রমাণ করেছেন তার ক্ষুরধার আগুনঝরা লেখনীর দ্বারা। তাঁর কলমকে ভয় করতো বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী, এ জন্যে তাঁর পাঁচটি গ্রন্থ ও বেশকিছু কবিতা, প্রবন্ধ এবং গান বৃটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। যে পাঁচটি বই বাজেয়াপ্ত করেছিলেন, সেগুলো হলো-(১) যুগবানী, (২) বিষের বাঁশি, (৩) ভাঙার গান, (৪) প্রলয় শিখা এবং (৫) চন্দ্রবিন্দু। নজরুল যেমন তাঁর আসল দুশমন চিনেছিলেন, এ জন্যে সেই দুশমনরা তার পেছনে লাগিয়েছিল গোয়েন্দা, তাকে পাঠিয়েছিল এই সুন্দর বসুন্ধরার ফুলে-ফলে ভরা সবুজ-শ্যামল গাছপালার অক্সিজেনযুক্ত আলো-বাতাসের পরিবেশের পরিবর্তে-হতশ্রীর আবছা আলো আবছা আঁধারে নিমজ্জিত কারাগারে। কিন্তু তারা (বৃটিশ শাসক) অসির চেয়ে ধারালো শক্তিশালী নজরুলের কলম বন্ধ করতে পারেনি। তিনি কারাগারে থেকেই ডাক দিয়েছিলেন-
‘‘কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কররে লোপাট
রক্তজমাট শিকল পুজোর পাষাণবেদী
ওরে ও তরুণ ঈশাণ, বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ
ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদী’’
দীর্ঘ প্রায় তিনদশক নির্বাক থাকার পর সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র) ইন্তেকাল করেন। কবির মনে-প্রাণে পরকালীন অনুভূতি ছিল সজাগ। তাই তিনি কালজয়ী ও মনোবাসনামূলক একটি গান লিখেছিলেনঃ
“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে
গোর-আজাব থেকে এ গুণাহগার পাইবে রেহাই।”
কবির সেই ইচ্ছে পূরণে ঢাবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
তাঁর চেতনা ও আদর্শ চিরভাস্বর হয়ে আছে আমাদের জীবনে। আজ ২৭ আগস্ট ২০১৭ তাঁর ৪০তম প্রয়াণদিবস। তাঁর বিদেহী আত্নার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ও খোদার দরবারে মাগি তাঁর জন্য ক্ষমা!
লেখকঃ 
প্রাবন্ধিক ও গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল-meemmizanru@gmail.com
Blogger দ্বারা পরিচালিত.